হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, পরিবার ও বিবাহবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং পরামর্শদাতা হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ আলিরেজা তিরাশিওন তাঁর এক বক্তব্যে “মানবিক চরিত্র গঠনে সঙ্গ–সাথের প্রভাব” বিষয়ে আলোচনা করেছেন, যা আপনাদের শ্রদ্ধেয় পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে।
আজকের বিশ্বে “প্রযুক্তি ও সুবিধাসমূহে পরিবর্তনের গতি” অতীতের তুলনায় অনেক বেশি। এই দ্রুত পরিবর্তনের কারণে আমাদের শিক্ষা–তরবিয়তের ক্ষেত্রেও নিজেদের পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। অর্থাৎ, আমাদের সন্তানদের লালন–পালনের ধরন সেই যুগ ও পরিবেশের উপযোগী হওয়া উচিত, যেখানে আমরা বসবাস করছি।
তরবিয়তের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—যা হাদিসেও উল্লেখ আছে—তা হলো “সঙ্গ ও পরিবেশ”।
এক হাদিসে এসেছে: “আল্মারউ আলা দ্বীনি খালিলিহি ও কারীনিহি” – অর্থাৎ, মানুষ তার সাথী ও পরিবেশের ধর্ম–নৈতিকতার ওপর চলতে থাকে।
এই বাণী থেকেই বোঝা যায় যে সঙ্গ–সাথ এবং শিক্ষামূলক পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
এই ভিত্তিতে, বাবা–মা এবং সব ধরনের শিক্ষকদের উচিত “তরবিয়তপূর্ণ জীবন” যাপন করা। অর্থাৎ, তাদের সচেতন থাকা দরকার যে তাদের প্রতিটি কাজ, চলাফেরা, কথাবার্তা এমনকি আবেগিক প্রতিক্রিয়াও সন্তানের শেখার নজরে থাকে।
বিশেষত মা—যিনি সন্তানের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত করেন—তার উচিত নিজের আচরণ সম্পর্কে শিক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা এবং জানা যে তার ক্ষুদ্রতম কাজটিও সন্তানের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
চোখ দিয়ে শেখা, মুখের কথায় নয়
সাধারণত আমরা শিক্ষার দুইটি পথের কথা বলি—
একটি হলো “মুখের কথা দ্বারা শিক্ষা”
অন্যটি হলো “ব্যবহারিক বা কাজের মাধ্যমে শিক্ষা”।
প্রথম পদ্ধতিতে বাবা–মা সন্তানদের সব সময় উপদেশ দেন—ভালো কাজের কথা বলেন, ভালো আচরণ শেখান, বড়দের সম্মান ও বাবা–মায়ের আদর–সম্মানের কথা বলেন।
কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ধতিতে সন্তান “দেখে ও পর্যবেক্ষণ করে” শিখে। বাস্তবে, বাবা–মা “শিশুর চোখের জানালা” দিয়ে তার মন, চিন্তা ও আচরণকে প্রভাবিত করেন।
এই বিষয়ে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
যখন মানুষ কোনো ছবি দেখে, সেই ছবি প্রায় তিরিশ বছর পর্যন্ত তার মনে থেকে যেতে পারে; কিন্তু কোনো শোনা কথা সাধারণত ৭ থেকে ১০ সেকেন্ড পর্যন্ত মনে থাকে।
অতএব, দেখা—শোনার তুলনায়—কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালী ও স্থায়ী প্রভাব ফেলে। এক বিখ্যাত বক্তা বলতেন:
“আপনি যদি শ্রেষ্ঠ বক্তৃতাও দেন, তবুও কয়েক ঘণ্টা পর শ্রোতাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা বলবে—ভালো কথা বলেছেন। কিন্তু ঠিক কী বলেছেন তা বলতে গেলে, এক ঘণ্টার বক্তৃতা থেকে দু’টি বাক্যও ঠিকঠাক বলতে পারবে না!”
শুনে–শুনেও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক আলেমের একটি ঘটনা প্রচলিত আছে:
বক্তৃতা শেষে এক ব্যক্তি রাগান্বিত হয়ে বললেন: “আপনি কীভাবে এমন বিদআত বললেন যে, বাছুরকে গোসল করানো, কাফন পরানো, জানাজা পড়ানো ও দাফন করা উচিত!”
আলেম হাসলেন এবং বললেন: “আমি বাছুর বলিনি; বলেছিলাম দু’বছরের শিশুকে গোসল দাও!”
এই ভুল শোনার ঘটনা প্রমাণ করে যে শোনা কথা বুঝতেও ভুল হতে পারে। আর শিশুরা তো আরও বেশি—তারা দেখে শেখে, নসিহত শুনে নয়।
শিশু শুধু ঘর নয়, সমাজকেও দেখে
পরামর্শের সেশনে আমি বহুবার দেখেছি, খুব ছোট ছোট শিশুরাও বাবা–মায়ের আচরণ বিশ্লেষণ করে।
একদিন এক পাঁচ বছর বয়সী শিশু আমাকে বলল: “আঙ্কেল, আমি আমার মাকে কী বলব?”
কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলল: “তিনি খুব রাগ করেন!”
এটি দেখায় যে শিশু মায়ের রাগ বুঝেছে এবং তা তার ওপর প্রভাব ফেলেছে।
সুতরাং কেবল নসিহত দিয়ে তাকে ঠিক পথে চলতে বাধ্য করা সম্ভব নয়, যখন মায়ের নিজের আচরণ তার বিপরীত বার্তা দিচ্ছে।
আজকের তরবিয়তের একটি বড় দুশ্চিন্তা হলো—সমাজের পরিবেশও শিক্ষামূলক হওয়া উচিত।
দুঃখজনকভাবে, অনেক সময় বাবা–মা সন্তানকে সঠিকভাবে মানুষ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন, কিন্তু সমাজ—স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি পাড়ামহল্লা—এমন সব আচরণের নমুনা দেখায় যা সন্তানের উপর প্রভাব ফেলে এবং তার চরিত্র গঠনের ধারা পরিবর্তন করে দেয়।
শিশু শুধু ঘর নয়—সমাজকেও দেখে।
আপনার কমেন্ট